সাত দিনের ছুটি শেষ হয়ে এলো। কাল থেকে অফিস শুরু। সত্যি বলতে এই সাত সাতটা দিন যেন উবে গেলো পাখির ডানায় ভেসে। এই সাত দিনে বাবা একটাবারও ফোন করেননি। আমি জানতাম উনি কখনই ফোন করবেননা তবুও মনের কোনে কোথায় যেন ক্ষীন একটা আশা লুকিয়ে ছিলো। মা ফোন করেছিলেন একদিন। জানতে চাইলেন, ভালো আছি কিনা? আমি বললাম, আমি ভালো আছি মা, কিন্তু আমাকে নিয়ে মোটেও চিন্তা করে আবার তুমি খারাপ থেকোনা। বাবার দিকে খেয়াল রাখো। মা বললেন, আচ্ছা। ঐ অতটুকুই। মাঝে মাঝে আমার মাকে দেখে অবাক লাগে। এমন নিভৃতচারিনী পতিব্রতা স্ত্রী আমি কখনই হতে পারবো না তবে আমি শুভ্রকে অনেক ভালোবাসি। তাই আমি আমার সকল বিত্ত বৈভবের জীবন ছেড়ে এই চিলেকোঠার সংসারে উঠে এসেছি ওর হাত ধরে। আমার ধারনা মা কখনও বাবাকে ভালোবাসেননি। চিরজীবন এক ভালোবাসাহীন কর্তব্য পরায়ন পতিব্রতা স্ত্রীর ধর্ম পালন করে গেছেন মাত্র।
এই সাতদিনে আমি শুভ্রর এই চিলেকোঠার ঘরটার হতচ্ছাড়া চেহারাটা অনেকটাই বদলে দিয়েছি। প্রথমে অবশ্য শুভ্রই এর সূচনা ঘটিয়েছে। আর সব কিছু সহ্য হলেও ওয়াশরুমের ভয়ংকর অবস্থাটা আমি কিছুতেই সহ্য করে উঠতে পারছিলাম না। ওয়াশ রুমে যেতে হলেই আমার করুন চেহারা দেখে শুভ্র ঠিকই বুঝে ফেললো আমার মনের অবস্থা। তাই একদিন সকালে নিজেই ঝেঁড়ে মুছে ঝেঁটিয়ে বিদায় করলো সব ভাঙ্গা চোরা পুরান বালতি মাগ, কাপড়ের দড়িদাড়া সব কিছু। উফ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। আর সেই সুযোগে তড়িঘড়ি আমিও সেদিন বিকেলেই ওর সাথে গিয়ে নিয়ে এলাম নতুন ঝকঝকে তকতকে যা কিছু প্রয়োজন ওয়াশরুম আর কিচেনের জন্য। এর পর এই চিলেকোঠার চেহারা বদলাতে উঠে পড়ে লাগলাম। মেঝেতে ফ্লোরম্যাট বসিয়ে জানালার পর্দা বদলে ফেলে, চাদর বালিশ টেবল ক্লথ বদলে সাফ সুতরো করে বলতে গেলে একেবারেই গ্রান্ড সুলতান লুক না হলেও গাজীপুরের যেকোনো সুন্দর রিসোর্ট লুক বানিয়ে ফেললাম।
ঘরের সামনে রঙ্গিন ফুলের ছোট ছট টবও বসিয়ে দিয়েছি। এখন এই এই চিলেকোঠাই আমার স্বর্গ। মাঝে মাঝে নিজেই তাকিয়ে মুগ্ধ হই নিজের কারিশমায়। সেদিন বাড়িওয়ালার বউ এসে তো তার এই বিদঘুটে রুমের বদখত চেহারার ভোল পালটে যাওয়া দেখে একেবারেই টাসকি খেয়েছিলো। গালে হাত দিয়ে বসেছিলো সে আমার দেশী শপগুলো থেকে কিনে আনা রঙচঙা রিক্সা পেইন্টের ছোট টি-টেবল সেটের টুলটাতে । চারিদিকে তাকিয়ে তুকিয়ে শেষে পান দোক্তা খাওয়া মুখে বলেই ফেললো, বাব্বা ধন্যি মেয়ে বটে। চোখের পলকে দেখতেছি রাতকে দিন বানায় ফেলছো। তা বাবা তোমাকে দেখে তো বড় ঘরের মেয়ে মনে হয়। কোন বুদ্ধিতে এই নির্বুদ্ধির কাজটা করলা বলোতো! রোজগার নাই, পাতি নাই তো তোমার স্বামী খাওয়াবেটা কি?
আমি বললাম, ওর পড়ালেখা শেষ হতে তো বেশী দেরী নেই। ততদিন না হয় আমার একার আয়েই চলবে। দুজনের সংসার ঠিক চলে যাবে। এই কথা শুনে মনে হয় বাড়িওয়ালা গিন্নি আর একটু হলে ভীমরী খেয়েই চোখ উলটে পড়তো। সে বিস্ফারিত নেত্রে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন তারপর পানের পিক সামলে নিয়ে বললেন, তা তুমি কি করো? রোজগার করো নাকি? তাই তো বলি, তুমি রোজগেরে গিন্নী? আমাদের বাবাজান দেখি বড়শীতেই বড় মাছটাই ধরসে। তা কি চাকরী? কত আয়? তোমার দেবতার তো এখনও পড়ালেখাই শেষ হয়নি। তো সে তোমার চাইতে পিছায় আছে কেনো? ফেইল টেইল করছিলো নাকি?
আমার তার কথা বলার স্টাইল দেখে একটুও রাগ লাগছিলো না বরং হাসিই পাচ্ছিলো। আমি বললাম না ফেইল করেনি। আমার পড়ালেখা আগে শেষ হয়েছে। কারণ আমি ওর আগে ছোটকালে পরালেখা শুরু করেছিলাম তো মানে আমি ওর চাইতে দু বছরের বড় তাই। আমার হাসি হাসি মুখে নির্দ্বিধায় এই কথা বলতে শুনে উনার বিস্ফারিত নেত্র আরো আলু হয়ে উঠলো। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে খানিক পরে ফোস করে নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, কলিকাল। কলিকালে কত কি দেখবো। জামায়ের চাইতে বউ বড়। এমন সৃষ্টিছাড়া কথা শুনছি বটে কিন্তু জন্মে চোক্ষে দেখিনি, আজ দেখলাম। চল শেলী বাসায় চল। তোকে নিয়েও ভয়ে থাকি মা। কবে আবার কোন দূর্ঘটনা ঘটায় বসিস!
এতক্ষনে হাসি হাসি মুখে মায়ের সব কথা শুনে খুবই কৌতুক পাচ্ছিলো বাড়িউলীর মেয়েটাও। সে মায়ের কথা শুনে বললো, তুমি যাও মা আমি একটু পরে আসছি। মেয়ের কথাটা মায়ের মোটেও পছন্দ হলোনা, তিনি মনে হয় সন্দিহান আমার পাল্লায় পড়ে মেয়ে আবার কোন অঘটন ঘটায় বুঝি। তারপরও মেয়ের কথা পছন্দ না হলেও তিনি বুঝলেন জোরাজুরি কাজ হবেনা। তাই ব্যর্থ রাগ দেখিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি আসবি। একটু পরেই তোর মাস্টার আসবে। ১৫ মিনিটের মধ্যে আসা চাই। লেখাপড়ার তো বালাই নেই। মা চলে যেতেই ফুটফুটে চেহারার মেয়েটা বললো, তুমি কিছু মনে করো না। মা না এমনই। সব কিছুতেই দোষ ধরে। তোমাকে আমার খুবই ভালো লেগেছে। তোমার নাম কি? কিশোরী চপলতায় নানা কথা বলে চললো সে। তার থেকেই জানা হলো সে ক্লাস টেনে পড়ছে। মা কখনই তাকে ছাদে আসতে দেন না। বড় বেশি চোখে চোখে রাখেন। আমি বুঝলাম আর দশটা মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী সমাজে যা হয় আর কি। মেয়েটা জানালো ওর নাম শিউলী। শিউলী ফুলের মতই কোমল আর অনিন্দ্য সুন্দর মেয়েটা। শুধু তাই না পান দোক্তা খেয়ে দাঁতগুলো তরমুজের বিঁচি বানিয়ে ফেলা মায়ের মত অন্যকে আঘাত করে কথা বলার মত মেন্টালিটিও নেই মেয়েটার। শিউলী বললো মা নিষেধ করলেও এখন থেকে ও মাঝে মাঝেই আমার কাছে আসবে।
সন্ধ্যা হচ্ছে। কাল সকাল থেকেই অফিস শুরু হবে। ভাবতেই কান্না পাচ্ছে আমার। শুভ্রকে ছেড়ে আমার এক মুহুর্ত থাকতে ইচ্ছা করে না আজকাল। বউ পাগলা মানুষ হয় শুনেছি। জামাই পাগলী বউ হয় কখনই শুনিনি। নিজেই এ কথা মনে করে নিজে নিজেই হাসি আমি। ঘুম ভেঙ্গেই ওর মুখে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। ওর কোঁকড়া চুলে হাত বুলাই আমি। একদম শিশুর মত ঘুমিয়ে থাকে শুভ্র। আমি ওর ঘুমন্ত মুখে হাত বুলাই। শুভ্র খুব রাত জাগে । খুবই বাজে অভ্যাস এটা ওর। আগেও আমি ঘুমিয়ে পড়তাম কিন্তু ও আমাকে অনলাইন বা ফোন ছেড়ে ছাড়তেই চাইতো না। আমি ঘুমে ঢুলে পড়ছি এই কথা তো বিশ্বাসই হত না তার। কারন ওমন করে কখনও ঘুমই পায়না নাকি ওর। এ কি অবাক করা কথা! আমি খুব অবাক হতাম। বিয়ের পরে বুঝেছি খুব পাতলা আর কম ঘুম ওর। কিন্তু ভোরের বেলায় গভীর নিদ্রায় হারিয়ে যায়। আর সেই সময়টাতেই আমি জেগে উঠি। তাকিয়ে দেখি আমার ঘুমপূরীর রাজকুমারকে। পা টিপে টিপে উঠি যেন ওর ঘুম না ভেঙ্গে যায়।
আবোল তাবোল আমার এই সাত দিনের সংসারের স্মৃতিমধুর ভাবনায় ছেদ পড়লো শুভ্রর কলিংবেলের শব্দে। ঘেমে নেয়ে দুহাত ভর্তি করে কি কি সব কিনে এনেছে। আমি তো কিছু কিনতে বলিনি। শুভ্র বললো, কাল সকালে তোমার অফিস। অতো ভোরে কি খাবে তাই রেডিমেড খাওয়া যায় এসব আর কি, ব্রেড কলা এইসবই। ওর বোকার মত ভাবনা দেখে, আমতা আমতা অজুহাত দেখে আমার রাগ লাগছিলো। আরে আমি তো বাইরেই খেয়ে নিতে পারবো দরকার হলে। নিজের জন্য চিন্তা নাই কতদিন শুনেছি না খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছে আর আজ আমার জন্য এত ভাবনা। কিন্তু ওর বোকা বোকা মুখের দিকে তাকিয়ে বড্ড মায়া হলো। এই জামাই পাগলী আমি হঠাৎ পুরো পাগলী হয়েই ওকে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর ওকে অজস্র চুমুতে ভাসিয়ে দিতে শুরু করলাম। হা হা জানিনা এমন পাগলামী কেনো যে করতাম আমি। আমার এই হঠাৎ কান্ড দেখে শুভ্রও হকচকিয়ে গেলো। প্রায় পড়তে পড়তে আমাকে ধরে ফেললো। সেই দৃশ্য মনে পড়লে আজও আমার বড় হাসি পায়। লজ্জাও লাগে। এখনও এই কথা লিখতে লজ্জা হচ্ছে আমার একটু।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:৫৮